মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৪

ছোটগল্প : বর্ষাফুল

lf thou showest me not thy face
lf thou leavest me wholly aside
I know not how I am to pass
These long rainy hours.
– Rabindranath Tagore
সকাল বেলা ঘুম থেকে থেকে জেগেই মিতুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সেই সাথে মেজাজও চড়ে গেলো হাই ভোল্টে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো জহির। মিতুর ফুফাতো ভাই।
হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, মিতু, একটা আলপিন দে তো!
মিতু কড়া করে বকা দিতে গিয়েও থেমে গেলো। একটি প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের ঘরে যে ছেলে হুট হাট করে ঢুকে যায় তার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীন ছেলেকে বকা দেয়া, না-দেয়া এক কথা।
কি হলো মিতু! বললাম না একটা আলপিন দিতে?
আমার কাছে আলপিন নেই। অত্যন্ত নিচু স্বরে বললো মিতু।
আকাশ থেকে পড়লো জহির। এমন আচানক কথা সে জীবনেও শুনেনি। তার কোনো কিছুর প্রয়োজন হলেই সে মিতুর কাছে দৌড়ে আসে। আজ পর্যন্ত সে না শব্দটি মিতুর কাছে শুনেনি। তাই এখন সে কি করবে বুঝতে পারলো না। খানিক দাঁড়িয়ে থেকে জহির রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
মিতুর মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয় দুপুর পেরিয়ে গেলেও এই বৃষ্টি থামবে না। অথচ দশটার সময় জর্জের সাথে দেখা করার কথা। মিতুকে জর্জ ভালোবাসে।
জানালা খুলে দিতেই এক পশলা ঠাণ্ডা বাতাস মিতুর রেশমি চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো।
এখন বৃষ্টি একটু কম।
ছোট্ট একটি ছেলেকে দেখলো মিতু, যে অনেকগুলো কদম ফুল নিয়ে যাচ্ছে।
মিতু ক্যালেন্ডার উল্টিয়ে দেখলো আজ আষাঢ় মাসের প্রথম দিন। অর্থাৎ বর্ষার প্রথম দিন।
হঠাৎ করেই মিতুর মনটা আশ্চর্যরকম ভালো হয়ে গেলো। মেজাজও ফুরফুরে হয়ে গেলো নিমিষে।
মিতু অনেক খুঁজে একটা আলপিন বের করলো।
জহিরের রুমে গিয়ে দেখলো, জহির একটা টিকটিকিকে খুব মনোযোগসহকারে দেখছে।
এই নে, আলপিন। হঠাৎ মিতুর কণ্ঠ শুনে জহির লাফিয়ে উঠলো। আলপিন হাতে দাঁড়িয়ে আছে মিতু।
আলপিন হাতে নিয়ে খুব কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে মিতুর দিকে তাকিয়ে রইলো জহির। তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ দিতে হবে না। আলপিন দিয়ে কী করবি সেটা বল, চলে যাই শুনে। হাতে সময় নেই।
মিতুর কথা শুনে রহস্যজনকভাবে হাসতে লাগলো জহির।
বলা যাবে না তোকে।
এমনভাবে কথাটা বললো জহির, যেনো আলপিন দিয়ে কী করবে এটা না-বলা খুব মজার একটা ব্যাপার।
মিতু রাগতে গিয়েও দমে গেলো। আজ কারও সাথে রাগবে না মিতু। খারাপ ব্যবহারও করবে না।
সে জহিরের ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। আটটা বেজে গেছে। দশটার মধ্যে টিএসসিতে যেতে হবে। দুপুরের পরে কাস আছে। কাসের আগেই জর্জের সাথে দেখা করতে হবে।
এক.
মিতু বাসা থেকে বেরিয়েই একগুচ্ছ তরতাজা কদম ফুল কিনলো। এই বর্ষার প্রথম কদম ফুল জর্জকে দেবে।


দুই.
মিতু অনেকণ যাবৎ অপো করছে অথচ জর্জের পাত্তা নেই। জর্জ এরকম কখনোই করে না। প্রথমে মিতুর খুব রাগ হলো। শেষে ভয় পেয়ে গেলাÑ জর্জের অসুখ করেনি তো! মিতু বিরক্ত হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো।
আর তখুনি দেখলো জর্জ সিএনজি থেকে নামছে। আর তার হাত ধরে নামছে তাদের ডিপার্টমেন্টের মেয়ে শ্রেয়া।
মিতুর দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো জর্জ।
আর শ্রেয়া মিতুর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসলো। তারপর ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলো।
মিতু রাগে অভিমানে কেঁদে ফেলছিলো প্রায়। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলো।
হাতের ফুলগুলো ড্রেনে ছুঁড়তে যাচ্ছিলো। তখুনি দেখলো ওর ফুফাতো ভাই জহির হন্ত-দন্ত হয়ে তার দিকে আসছে। মিতু ফুলগুলো ফেললো না।
মিতু! তুই আমাকে না নিয়ে চলে এলি যে? জহিরের গলায় অভিমানের সুর।
তোকে নিয়ে আসতে হবে নাকি? তুই একা আসতে পারিস না? গাধা কোথাকার!
মিতুর এমন আচরণে জহির চুপসে গেলো। সে চুপ করে বসে পড়লো ঘাসের উপর।
কাসে যাবি না? মিতু জানতে চাইলো। তার মুখ রাগে থমথম করছে।
না, তুই যা। আমি নিজে নিজেই যেতে পারবো। স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলো জহির।
মনে শত যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও মিতুর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
খবরদার! এখানে স্ট্যাচুর মতো বসে থাকবি না। মিতু জহিরকে শাসলো। নে, আমর হাত ধরে উঠে আয়।
মিতুর দিকে তাকিয়ে অল্প হাসলো জহির। তারপর মিতুর হাত ধরে উঠে কাসের দিকে এগুলো দুজন।
ফুল আমার জন্যে এনেছিস্ মিতু?
জহিরের এমন কথায় থতমত খেলো মিতু। কিন্তু পরণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, হুঁ। এই ধর।
মিতু, তুই কি জানিস আজ বর্ষার প্রথম দিন?
মিতু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো।
বর্ষার প্রথম কদম ফুল ভালোবাসার মানুষকে দেয়, তা জানিস?
মিতু এবারও মাথা নাড়লো।
তুই তো আমায় ভালোবাসিস না, মিতু।
কিন্তু তুই তো বাসিস?
জহির হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
তাহলেই চলবে। বলতে বলতে মিতুর চোখে পানি এসে গেলো।
তার মনে হলো, জহিরকে সে অনেক অনেক ভালোবাসে। যা জর্জের সাথে ছিলো কৃত্রিমতায় ভরা। মিতু জহিরের হাতটা চেপে ধরলো।

কোন মন্তব্য নেই :

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন